নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য ভুগিয়েছে গত কয়েক বছর। ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে হু হু করে। গত ৫ আগস্টের পর নির্মাণ উপকরণের দাম কিছুটা কমলেও দেশ এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল নয়। এর মধ্যে রয়েছে ড্যাপ ও ফার ইস্যু। সব মিলিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না আবাসন খাত। দামের কারণে নতুন ফ্ল্যাট থেকে মুখ ফিরিয়ে পুরোনোয় ঝুঁকছেন ক্রেতারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) কারণে ফ্ল্যাটের নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। আবাসন খাতে নতুন প্রকল্পের সংখ্যা কমেছে। নতুন করে পাস হচ্ছে না প্ল্যান। নির্মাণব্যয় বাড়ায় রেডি ফ্ল্যাটের দামও কিছুটা বাড়তি। এসব কারণে পুরো আবাসন খাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফার ইস্যুতে স্থবিরতা চলছে ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি নির্মাণের কাজেও।
রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকায় প্রকল্প শেষ করেছেন আবাসন উদ্যোক্তা কামরুল ইসলাম। গত কয়েক মাসে কিছুটা কমেছে রড-সিমেন্টের দাম। যদিও দাম কমার প্রভাব তার প্রকল্প স্পর্শ করেনি। ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম বলেন, আমরা তিন বছর ধরে প্রকল্পের কাজ করেছি। এখন রেডি হলেও নির্মাণের কয়েকটি উপকরণের দাম কমেছে। ফ্ল্যাটের দাম শুনেই ক্রেতা ফিরে যাচ্ছেন, অভিযোগ করছেন দাম বেশি নেয়ার। অথচ আমাদের কাজ চলমান থাকা অবস্থায় নির্মাণের প্রধান উপকরণ রডের প্রতি টন বিক্রি হয়েছে এক লাখ টাকায়। বাড়তি দাম দিয়ে কেনা হয়েছে সিমেন্ট, বালু ও ইট। এখন কম দামে ছাড়লে লোকসান গুনতে হবে। এ কারণে আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছি।
একই কথা বলছেন অন্য ব্যবসায়ীরাও। উদ্যোক্তা মাহমুদ হাসান বলেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে গত কয়েক মাস ধরে। এ সময়ে ফ্ল্যাটের বিক্রি কম থাকায় অনেক ছোট প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতনসহ অফিস চালাতেও কষ্ট হচ্ছে। অনেকেই আবার অফিস চালাতে লোকসান দিয়ে কিছু ফ্ল্যাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে সার্বিক পরিস্থিরি উন্নতি আর খাতের সংকট দূর না হলে মুখ থুবড়ে পড়বে আবাসন খাতের ব্যবসা।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সূত্র বলছে, ২০১০-২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি ছিল। সেটা কমে ২০১৩-২০১৬ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১২ হাজারের বেশি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। তবে ২০১৭-২০২০ পর্যন্ত কিছুটা বেড়ে প্রতি বছর গড়ে বিক্রি হয়েছিল ১৪ হাজার ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট। ২০২০ সালের জুলাই-২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে বিক্রি হয় প্রায় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট। এর পর থেকেই ধস নামে নতুন প্ল্যান পাসে। বিক্রির গতিও মন্থর হয়। রিহ্যাবের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিক্রি হয় সাড়ে ৯ হাজার ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে প্রায় চার হাজার ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাভেদে ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেড়েছে। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সূত্র জানায়, ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে গুলশান-বনানীতে দুই থেকে আড়াই বছর আগেও প্রতি স্কয়ার ফুট ছিল ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে (লোকেশন অনুযায়ী) ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বনানীতে (লোকেশন অনুযায়ী) ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে রয়েছে, যা বিগত দুই থেকে আড়াই বছর আগেও বিক্রি হয়েছে ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকায়।
ধানমন্ডি এলাকায় আগে প্রতি স্কয়ার ফুটের দাম ছিল ১২ থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে। এখন তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৭ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে। মেট্রো এলাকা মিরপুরে (লোকেশনভেদে) প্রতি স্কয়ার ফুট বিক্রি হচ্ছে ৬ থেকে ৯ হাজার টাকা, যা আগে বিক্রি হয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায়। একইভাবে বেড়েছে বনশ্রী-আফতাবনগরেও। এ এলাকায় প্রতি স্কয়ার ফুট বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা, উত্তরা (সেক্টর অনুযায়ী) প্রতি স্কয়ার ফুট বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৭ থেকে ১৩ হাজার টাকার মধ্যে।
আবাসন ব্যবসায়ী এবং ব্রিক ওয়ার্কস লিমিটেডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ভুঁইয়া বলেন, বর্তমানে নতুন ড্যাপে ফার ইস্যু থাকায় ভবনের উচ্চতা কমেছে, এতে নতুন প্ল্যান পাস বন্ধ রয়েছে কোম্পানিগুলোর। যেসব কোম্পানির রেডি ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে সেটি আড়াই থেকে তিন বছর আগের তৈরি। সেসময় নির্মাণ উপকরণের দাম বেশি ছিল। এখন রড-মিসেন্ট ও ইটের দাম কমলেও এর প্রভাব রেডি ফ্ল্যাটে পড়েনি। এ কারণে চাইলেও কেউ কম দামে ফ্ল্যাট দিতে পারছেন না। তিনি বলেন, রড ও সিমেন্টের দাম কিছুটা কমলেও বালুর দাম এখনো আকাশচুম্বী। এছাড়া নতুন করে কোনো প্ল্যান পাস হচ্ছে না। এ কারণে নতুন ফ্ল্যাটের বুকিং দেয়ার পরিবর্তে অনেকে আবার পুরোনো বেছে নিচ্ছেন। নগরবাসীর আবাসন সংকট মেটাতে না পারার জন্য মূলত নতুন ড্যাপই দায়ী।
রেডি ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের উচ্চ মূল্যের কারণে অনেকেই এখন ঝুঁকছেন পুরোনো ফ্ল্যাটের দিকে। এতে দাম কম হওয়ার পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশনের খরচ কম। একটু সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে পুরোনো ফ্ল্যাটের কদর বেড়েছে। আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন কোম্পানি আর রেজিস্ট্রেশন অফিসের সূত্র দিয়ে রিহ্যাব জানায় বিগত বছরের তুলনায় এখন ধারাবাহিকভাবে চাহিদা বাড়ছে পুরোনো ফ্ল্যাটের।
বিশেষ করে মিরপুরের মণিপুরসহ মেট্রোরেল সংলগ্ন এলাকা, কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া, সেন্ট্রাল রোড, পান্থপথ, বাড্ডা, উত্তরখানসহ গ্যাস সংযোগ এবং বিদ্যুতের সমস্যা নেই এমন ফ্ল্যাটের কদর বেড়েছে বিগত কয়েক বছরে। মূলত তুলনামূলক কম দাম হওয়ায় এটা বেছে নিচ্ছেন তারা। ব্যাংকার মেনন মাহবুব বলেন, চাকরির প্রায় অর্ধেক টাকা বাসা ভাড়ায় চলে যাচ্ছে। এখন চাইলেও নতুন ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব হচ্ছে না বাড়তি দামের কারণে। এ কারণে গত বছর আমি পুরোনো ফ্ল্যাট কিনেছি। আবার নতুন ফ্ল্যাটে গ্যাস সংযোগের ঝামেলাও রয়েছে। বেশ ভালো ফ্ল্যাট হওয়ায় আমার আরও দুই সহকর্মী মিরপুর এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, আগে থেকেই নির্মাণ উপকরণের অতিরিক্ত দাম বাড়ার ফলে ছোট ফ্ল্যাটের খরচই দাঁড়ায় ৭৫ লাখ টাকার বেশি। বড় ও মাঝারি ফ্ল্যাটের খরচ আরও বেশি হচ্ছে। বর্তমানে নির্মাণের প্রধান উপকরণ রড ও সিমেন্টের দাম কিছুটা কমলেও রেডি ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়েনি। অর্থাৎ, কম দামের উপকরণে এখনকার রেডি ফ্ল্যাট নির্মাণ হয়নি। ফলে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বাড়তি দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বিক্রেতা।
রিহ্যাব সভাপতি বলেন, গত বছরের আগস্ট থেকে কার্যকর হয় ড্যাপ। এ ড্যাপে পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত এলাকার জন্য আলাদাভাবে ভবন নির্মাণের যে ফার নির্ধারণ করা হয়েছে তা বৈষম্যমূলক। ড্যাপের বিদ্যমান বৈষম্যের আগে বেশির ভাগ এলাকায় ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, সে তুলনায় এখন ৬০ শতাংশ পাওয়া যায়। এ কারণে জমির মালিক ও ফ্ল্যাটের ক্রেতা, ব্যবসায়ীসহ (বিক্রেতা) সবাই ক্ষতির মুখে পড়ছেন। আমরা ড্যাপের সংশোধন চাই, এটা না হলে আবাসনে সংকট বাড়বে, বাড়ির ভাড়াও বাড়বে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

নতুন ফ্ল্যাট থেকে মুখ ফিরিয়ে পুরোনোয় ঝুঁকছেন ক্রেতারা
আবাসন ব্যবসায়ীদের দুর্দিন কাটছে না
- আপলোড সময় : ১৩-০৩-২০২৫ ১২:১৫:৩১ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৩-০৩-২০২৫ ১২:১৫:৩১ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ